দু’মাস আগে মারা যাওয়া শশুড়ের ঘরে মাঝরাতে আবছা কিছু দেখতে পেলাম, জানলা দিয়ে। উনার ঘরের জানলা টা সবসময় খুলাই থাকে। আজও খোলা।শাঁ শাঁ শব্দ হুড় হুড় করে বাতাস ডুকছে ঘরে। আমি প্রথমে চোখের ভুল ভেবে নিলাম।ফের ও ঘরে চোখ পড়তেই ঘাবড়ে উঠলাম। এই তো আবছা ছায়া টা স্পষ্ট হচ্ছে ধীরে ধীরে। ওই ঘর আর আমার স্থানের দূরত্ব – মাঝখানে শুধু একটা করিডোর। আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি, ধবধবে সাদা কাপড় পরা কাউকে।মুখের অবয়ব এখনও বোঝা যাচ্ছে না। আমার ভেতর আত্মা হিম হয়ে গেল। তর তর করে কেঁপে উঠছি ক্রমান্বয়ে। হাত পা ক্রমশ অবশ হয়ে পড়ছে। ছিটকে সরে গেলাম পেছনে। এ জায়গা থেকে সরে যাওয়ার শক্তি ও এই মুহুর্তে পাচ্ছি না।আবার দাড়িয়ে থাকতেও পারছি না।
বাহিরে তুমুল বেগে বৃষ্টি নামলো। সাথে বাতাস। রাজবাড়ীর মতো ইয়া বড় বাড়ি আমাদের। চারপাশ প্রাচীরে ঘেরা। বাড়িতে এই মুহুর্তে কেউ নেই। স্বামী এখনও ফেরেনি। হয়তো বৃষ্টিতে আটকা পড়েছে।শাশুড়ী কানাডা গেছেন মেয়ের ওখানে। কাজের খালা সাকেরা, উনিও নেই বাড়িতে।মেয়ে পোয়াতি, দেখতে গেছেন।এই রাজবাড়ির মতো বিশাল বাড়িতে এখন শুধু আমি আছি আর ঘরে ঘুমিয়ে থাকা আমার মেয়ে।
এই ভয়ানক পরিস্থিতিতে কি করব বুজে উঠতে পারছি না। ভয় ভয় উত্তেজনা নিয়ে চোখ খুললাম আস্তে করে। এবার সাদা পোশাক পরা মানু্ষটা পুরোপুরি স্পষ্ট হয়ে উঠলো। রক্তবর্ণ চেহারায় আগুন চোখে জানলার গ্রিল ধরে, মুখ বাহির করে দাড়িয়ে আছেন আমার শশুড়। হে মুখটা উনারই। ফিসফিস করে বলছেন, “এদিকে এসো।”
আমি আন্দাজ করলাম, টাল খেতে খেতে পড়ে যাচ্ছি। আর কিছু মনে নেই।
সাঝসকালে নিজেকে আবিষ্কার করলাম বিছানায়।দিনের আলো ফুটে উঠেছে। রাতের কথা মনে পড়তেই ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলাম।মনে এক ঝাক প্রশ্ন উকি দিচ্ছে, “তারপর আমার কি হলো? কে নিয়ে আসলো এখানে?”
“তোমার কি শরীর খারাপ? রাতে বারিন্দায় ওভাবে পড়ে গেলে কেমনে?”
স্বামীর কথায় ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম ওর দিকে। বুঝলাম সে ই আমায় তুলে নিয়ে এসেছে ঘরে। একবার ভাবলাম রাতে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা তাকে খুলে বলি কিন্তু পরমুহূর্তে মত পাল্টালাম। নিজের মধ্যে একটা অদৃশ্য উত্তেজনা ভর করতে লাগলো। ঠিক করলাম, নিজে খতিয়ে দেখবো বিষয়টা। খুন বা আত্মহত্যা জনিত কিছু ঘটলে এমন হয়, লোকমুখে শুনা যায়। কিন্তু আমার শশুড়ের সাথে তো এমন কিছু হয়নি। উনি তো হার্ট এ্যাটাকে মারা যান।
বিছানা ছাড়লাম। এলোমেলো শাড়ি ঠিক করলাম। অগোছালো চুলগুলো কাকড়া দিয়ে বেধে নিলাম। রাজবাড়ির মতো বিশাল বড় বাড়ির গাছে গাছে তখন শুনা যাচ্ছে হরেক রকমের পাখির কিচিরমিচির শব্দ। গাছের সারিসারি পাতাগুলো অদ্ভুত শব্দে নড়ছে। সদর দরজা দিয়ে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, কয়েকটা কাঠবিড়ালি এ গাছ থেকে ও গাছে লাফ দিচ্ছে। রাতের মতো অতটা ভয় না লাগলেও, দিনের বেলাতেও এ বাড়িতে ভয় বিরাজ করে। এত বড় বাড়িতে মানুষ থাকবে শ’খানিক।গিজগিজ করবে চারপাশে। তা না! এ বাড়িতে আছি শুধু ছয় থেকে সাতজন মানুষ। মাঝমাঝে আমি একাই। মৃত্যুপুরী লাগে আমার গাছে।খানিক অবাক হলাম। এই মৃত্যুপুরীতে আমি কি করে আছি? আমার ভয় হয় না? নাকি দুর্দান্ত সাহসী মেয়ে আমি? আর পাঁচটা মেয়ে তো এভাবে থাকতে পারবে না!
সকালের নাস্তা করে করিডোর পেরিয়ে শশুড়ের ঘরের দরজা খুললাম।সাথে সাথে দক্ষিণের বাগানের বাতাস হু হু করে ডুকলো ঘরের ভেতর। বাতাসের শব্দটাও কি মর্মান্তিক! আমার ভেতরটা ভয়ে চুপসে গেলো। নড়েচড়ে ঘাড় সোজা করলাম। ভয় পেলে চলবে না।আমি ভয় পাবো না।
ছিমছাম ঘর।সব গোছানো যত্ন করে।দেয়ালে বড় একটা ফ্রেমে ঝুলিয়ে রাখা শশুড় আর শাশুড়ীর একসাথে তুলা একটি ছবি। সুন্দর লাগছে দুজনকে।
আমি ঘরের প্রতিটা কোণা খুব ভালোভাবে পরখ করলাম। না, সেরকম কিছু পাইনি। এমনকি কাল রাতের দেখা কোন চিহ্নই নেই। ভেতরে স্বস্তি অনুভব করলাম। ভাবলাম, হয়তো এমন কিছুই ছিলো না।আমার ঘোরলাগা ছিলো। জানলাটা বন্ধ করে দিলাম। এটা আর খোলা রাখা যাবে না। দরজায় তালা লাগিয়ে বেরিয়ে আসলাম।
কেটে গেল বেশ কয়েকদিন। সময়ের সাথে সাথে সেই রাতের কথা আমি ভুলেই গেলাম। ভেতর বাড়িতেই এখন দুজন কাজের লোক পার্মানেন্ট থাকে। শাশুড়ী ও বাড়ি আছেন।
এক রাতদুপুরে প্রবল বেগে আকাশ চুরমার হয়ে বৃষ্টি নেমে অশান্ত পৃথিবীকে মুহুর্তে শান্ত করে দিলো।আমার মন তখন অবাধ্য হয়ে উঠলো। আমার শখ আর ইচ্ছেগুলো বড্ড অদ্ভুত! আমার খুব করে ইচ্ছে করছে এই বৃষ্টিতে নিজেকে ভিজিয়ে দিতে।
বাড়ির সবাই তখন গভীর নিদ্রায় ঘুমের রাজ্যে।আমার স্বামী আর মেয়েও ঘুমিয়ে আছে। চুপিসারে বিছানা ছাড়লাম।লোহার গেট খুলে আবছা কালো অন্ধকার রাতে উঠোনের মাঝখানটায় এসে দাড়ালাম। চুলের খোপা খুলে হাত দুটো বাড়িয়ে আকাশের দিকে মুখ করে চোখজোড়া বন্ধ করলাম। মাথা থেকে পা পর্যন্ত বৃষ্টি নেমে নেমে ধুয়ে দিচ্ছে আমায়। এক অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করছে আমার ভেতরে।
‘রিপা’ বলে হঠাৎ কেউ ডেকে উঠলো।এই ঝুম বৃষ্টির মধ্যে আমার নামটা বেশ জোরে শুনালো। ভাবলাম স্বামী ডাকছে। চোখ বন্ধ অবস্থায় জবাব দিলাম, ” আসছি। প্লিজ আরও পাঁচটা মিনিট। এসো না তুমিও এসো।ভেজো বৃষ্টিতে।দেখবে খুব ভালো লাগবে।”
আমার কথা শেষ হতে না হতে “রিপা” বলে আবার করুণ গলায় কে যেন ডেকে উঠলো। এবার আমি একটু ফ্যাকাসে হয়ে গেলাম। কন্ঠটা চেনা মনে হচ্ছে। খুব চেনা।হৃদয়ের চেনা।ধুরু ধুরু বুকে এক বিশাল উত্তেজনা নিয়ে ধীরে ধীরে চোখ খুললাম।