Breaking News

প্রত্যেক পুরুষের বুকের ভেতর বাস করে একজন ব্যর্থ প্রেমিক, যে তার স্ত্রীকে অন্য পুরুষের হাতে তুলে দেয়।”

কী? পড়েই মনে হচ্ছে আমি পাগল হয়ে গেছি? মনে হচ্ছে, আমি একজন নির্লজ্জ লেখক, যে কিনা নারীর বিশ্বাসঘাতকতাকে বৈধতা দিয়ে সব দোষ পুরুষের ঘাড়ে চাপাচ্ছে? আপনার রক্ত যদি টগবগ করে ফুটতে শুরু করে, তবে আমি সঠিক পথেই এগোচ্ছি। আপনার ক্ষোভ, আপনার ঘৃণা—সবকিছুকেই স্বাগত। কিন্তু আমার একটাই শর্ত, লেখাটি শেষ করার আগে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাবেন না। যদি আপনার এতদিনের জমে থাকা ধারণাগুলোর ভিত নাড়িয়ে দিতে না পারি, যদি আপনার আত্মবিশ্বাসের আয়নায় ফাটল ধরাতে না পারি, তবে বুঝবেন এই লেখা ব্যর্থ।
আমরা এমন এক অদ্ভুত সমাজে বাস করি, যেখানে একজন নারী ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেই তার চরিত্রে ‘নষ্টা’ বা ‘চরিত্রহীনা’র সিলমোহর লাগিয়ে দেওয়া হয়। আমরা খুব সহজেই তাকে বিচারকের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিই। কিন্তু আমরা কি কখনো সেই কাঠগড়ায় দাঁড়ানো নারীর পাশের খালি জায়গাটার দিকে তাকিয়ে দেখেছি? সেই জায়গাটা তো তার স্বামীর! সেই মানুষটার, যার অদৃশ্য ধাক্কাতেই হয়তো নারীটি খাদের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছিল।

এই লেখাটি কোনো বিশ্বাসঘাতক নারীর সাফাই নয়। পরকীয়া নিঃসন্দেহে একটি জঘন্য অপরাধ, একটি পাপ। কিন্তু এই লেখাটি হলো সেই অপরাধের ময়নাতদন্ত। সেই অদৃশ্য কারণগুলোকে খুঁজে বের করার চেষ্টা, যা একজন ‘লক্ষ্মী’ স্ত্রীকে, একজন ‘ভালো’ মাকে তার সাজানো সংসার ছেড়ে এক অনিশ্চিত সম্পর্কের দিকে ঠেলে দেয়। এই লেখাটি শুধু নারীর জন্য নয়, এটা প্রতিটি পুরুষের জন্যও এক নির্মম আয়না।
অধ্যায় ১: বিছানা যখন কবরস্থান
চলুন, সবচেয়ে নোংরা সত্যটা দিয়েই শুরু করি। একজন নারীর পরকীয়ার অন্যতম প্রধান কারণ জন্ম নেয় তার নিজের শোবার ঘরে, তার নিজের বিছানায়।
ভেবে দেখুন সেই রাতের কথা। স্বামী সারাদিনের ক্লান্তিতে चूर। ঘরে ফিরে তার শুধু একটাই চাহিদা—শারীরিক। সে তার স্ত্রীর শরীরটাকে ব্যবহার করে একটা যন্ত্রের মতো। কোনো আবেগ নেই, কোনো ভালোবাসা নেই, কোনো দীর্ঘ চুম্বন বা প্রেমময় স্পর্শ নেই। আছে শুধু তাড়াহুড়ো, ঘাম এবং শেষে একতরফা তৃপ্তির পর পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়া।
আর নারীটি? সে পড়ে থাকে পাশে, একরাশ অতৃপ্তি আর অপমান নিয়ে। তার শরীরটা ব্যবহৃত হয়েছে, কিন্তু তার মনটা রয়ে গেছে মরুভূমির মতো শুকনো। সে চেয়েছিল একটু প্রেম, একটু আদর, একটু সময়। সে চেয়েছিল তার স্বামী তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলুক, “তোমাকে ভালোবাসি।” কিন্তু সে পেয়েছে শুধু এক যান্ত্রিক যৌনাচার।
দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর যখন এই ঘটনা ঘটতে থাকে, তখন সেই বিছানাটা আর ভালোবাসার মন্দির থাকে না, হয়ে ওঠে একটা কবরস্থান। নারীটি সেই কবরে জীবন্ত دفن (দাফন) হয়ে যায়।
ঠিক তখনই, তার জীবনে যদি এমন কেউ আসে, যে তাকে দুটো মিষ্টি কথা বলে, তার সৌন্দর্যের প্রশংসা করে, তার মন খারাপের কারণ জানতে চায়—তখন কী হয়? যে নারী তার নিজের স্বামীর কাছে বছরের পর বছর ধরে এক ফোঁটা মানসিক তৃষ্ণার জল পায়নি, সে যখন বাইরের কারো কাছ থেকে এক বালতি ভালোবাসা পায়, তখন তার বিবেক, তার নৈতিকতা—সবকিছু ভেসে যেতে বাধ্য।
যে স্বামী নিজের স্ত্রীকে বিছানায় তৃপ্তি দিতে পারে না, তাকে মানসিক আশ্রয় দিতে পারে না, সে আসলে নিজের অজান্তেই অন্য পুরুষের জন্য দরজাটা খুলে দেয়। সে তার স্ত্রীকে ভালোবাসার কাঙাল বানিয়ে রাস্তায় ছেড়ে দেয়। তারপর অন্য কেউ যদি সেই কাঙালকে এক টুকরো রুটি দেয়, তখন দোষটা কি শুধু সেই কাঙালের?
অধ্যায় ২: কানের ক্ষুধা পেটের ক্ষুধার চেয়েও ভয়ঙ্কর
পুরুষের মূল চাহিদা শারীরিক, কিন্তু নারীর মূল চাহিদা মানসিক। তার কানেরও একটা ক্ষুধা আছে। প্রশংসার ক্ষুধা, মনোযোগের ক্ষুধা, গুরুত্ব পাওয়ার ক্ষুধা।
ভেবে দেখুন, আপনি শেষ কবে আপনার স্ত্রীর রান্নার প্রশংসা করেছেন? শেষ কবে তাকে বলেছেন, “এই শাড়িটাতে তোমাকে দারুণ লাগছে”? শেষ কবে তার হাতটা ধরে শুধু তার সারাদিনের গল্পটা মন দিয়ে শুনেছেন, কোনো সমাধান না দিয়ে, কোনো উপদেশ না দিয়ে?
হয়তো আপনার মনেও নেই। কারণ আপনার কাছে এগুলো ‘ন্যাকামি’। আপনার কাছে সংসার মানে টাকা রোজগার করা আর দায়িত্ব পালন করা। কিন্তু আপনি ভুলে গেছেন, নারী শুধু ইট-সিমেন্টের ঘর চায় না, সে চায় একটা ভালোবাসার আশ্রয়।
যখন আপনি তার এই মানসিক চাহিদাগুলো পূরণ করতে ব্যর্থ হন, তখন সে ভেতরে ভেতরে শুকিয়ে যেতে থাকে। তার আত্মবিশ্বাস কমে যায়। সে নিজেকে মূল্যহীন ভাবতে শুরু করে।
এই শূন্যতার সুযোগটাই নেয় বাইরের কোনো পুরুষ। সে হয়তো আপনার মতো টাকাওয়ালা নয়, আপনার মতো সুদর্শনও নয়। কিন্তু তার কাছে এমন কিছু আছে, যা আপনার কাছে নেই—সময় এবং মনোযোগ। সে আপনার স্ত্রীর কথা শোনে। সে তার ছোট ছোট বিষয়ের প্রশংসা করে। সে তাকে অনুভব করায় যে, সে এখনো আকর্ষণীয়, সে এখনো কাঙ্ক্ষিত।
নারীর কানের এই ক্ষুধা পেটের ক্ষুধার চেয়েও ভয়ঙ্কর। এই ক্ষুধা মেটাতে সে নিজের সাজানো সংসার, সন্তান, সম্মান—সবকিছুকে বাজি রাখতে পারে। যে পুরুষ এই সত্যটা বোঝে না, সে পৃথিবীর সবচেয়ে বোকা স্বামী। সে দামি গয়না দিয়ে স্ত্রীর শরীর সাজাতে পারে, কিন্তু তার আত্মাকে সাজাতে পারে না। আর যে আত্মা খালি, সে আত্মা নতুন ঘরের সন্ধান করবেই।
অধ্যায় ৩: ভালো ছেলে বনাম খারাপ ছেলে – আকর্ষণের নিষিদ্ধ রসায়ন
সমাজ আমাদের শেখায়, মেয়েরা ‘ভালো ছেলে’ পছন্দ করে। যারা শান্ত, ভদ্র, দায়িত্বশীল এবং নিরাপদ। বিয়ে করার জন্য এটা হয়তো সত্যি। কিন্তু আকর্ষণ? আকর্ষণ এক ভিন্ন এবং বিপজ্জনক খেলা।
আপনার স্ত্রী হয়তো আপনাকে বিয়ে করেছে আপনার নিরাপত্তা, আপনার দায়িত্ববোধ দেখে। কিন্তু তার মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা নারীসত্তাটা হয়তো এখনো সেই ‘খারাপ ছেলে’টাকেই খোঁজে, যার মধ্যে আছে একটুখানি বন্যতা, একটুখানি অনিশ্চয়তা আর অনেকটা আবেগ।
আপনি হয়তো একজন নিখুঁত স্বামী। আপনি সময়মতো বাড়ি ফেরেন, বাজার করেন, সন্তানের যত্ন নেন। আপনার জীবনে কোনো নাটকীয়তা নেই, কোনো উত্তেজনা নেই। আপনার ভালোবাসাটা অনেকটা ডাল-ভাতের মতো—ضروری (জরুরি), কিন্তু স্বাদহীন।
আর বাইরের সেই পুরুষ? সে হয়তো আপনার মতো নির্ভরযোগ্য নয়। কিন্তু সে উত্তেজনাপূর্ণ। সে আপনার স্ত্রীর সাথে এমনভাবে কথা বলে, যা আপনি কখনো বলেননি। সে তাকে এমন জগতে নিয়ে যায়, যা আপনার চারদেয়ালের সংসারে নেই। সে তার ভেতরের ঘুমন্ত নারীটাকে জাগিয়ে তোলে।
যে নারী তার স্বামীর সাথে শুধু ‘দায়িত্বের’ সম্পর্ক পালন করতে করতে ক্লান্ত, সে একটুখানি ‘উত্তেজনা’র জন্য, একটুখানি ‘নিষিদ্ধ’ আনন্দের জন্য নিজের সবকিছু ধ্বংস করে দিতে পারে।
আপনি যদি আপনার স্ত্রীর কাছে শুধু একজন ‘ভালো স্বামী’ হয়েই থেকে যান, কিন্তু একজন ‘আবেগপ্রবণ প্রেমিক’ হতে না পারেন, তবে আপনি তাকে এমন এক ফাঁদে ঠেলে দিচ্ছেন, যেখান থেকে ফেরা খুব কঠিন। সম্পর্কে ভালোবাসা, সম্মান, দায়িত্বের পাশাপাশি একটুখানি পাগলামি, একটুখানি উত্তেজনাও দরকার। লবণ ছাড়া যেমন তরকারি বিস্বাদ, উত্তেজনা ছাড়াও সম্পর্ক তেমনি পানসে।
অধ্যায় ৪: নীরবতার অপরাধ – যখন কথা বলাই সমাধান
সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি কী জানেন? বহু সম্পর্ক শুধু কথা না বলার কারণে ধ্বংস হয়ে যায়।
স্ত্রী তার অতৃপ্তি, তার কষ্ট, তার একাকীত্বের কথা স্বামীকে বলতে ভয় পায়। তার মনে হয়, স্বামী তাকে ভুল বুঝবে, তাকে ‘খারাপ মেয়ে’ ভাববে বা তার সমস্যাটাকে গুরুত্বই দেবে না।
আর স্বামী? সে ধরেই নেয়, সবকিছু ঠিকঠাক চলছে। সে ভাবে, সে যেহেতু টাকা দিচ্ছে, দায়িত্ব পালন করছে, তার মানে স্ত্রীสุข (সুখে) আছে। সে স্ত্রীর নীরব মুখটার আড়ালে জমে থাকা ঝড়ের খবরই রাখে না।
এই যে কমিউনিকেশন গ্যাপ, এই নীরবতাই হলো পরকীয়ার আঁতুড়ঘর। যদি একজন স্ত্রী তার স্বামীকে নির্ভয়ে বলতে পারত, “আমার তোমাকে আরও বেশি করে কাছে পেতে ইচ্ছে করে,” অথবা “আমার খুব একা লাগে,” এবং স্বামী যদি সেই কথাগুলো মন দিয়ে শুনে তার সমাধান করার চেষ্টা করত, তাহলে হয়তো ৯৯% পরকীয়ার জন্মই হতো না।
কিন্তু আমরা কথা বলি না। আমরা অভিনয় করি। আমরা ‘সব ঠিক আছে’র মুখোশ পরে দিনের পর দিন কাটিয়ে দিই, যতক্ষণ না একদিন সবকিছু ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।
শেষ কথা: আয়নার সামনে দাঁড়ান
যদি আপনার স্ত্রী আপনাকে ঠকিয়ে থাকে, তবে নিঃসন্দেহে সে একজন অপরাধী। সে পাপী। তার কোনো ক্ষমা নেই।
কিন্তু সেই বিচারের আগে, একবার আয়নার সামনে দাঁড়ান। নিজের চোখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করুন:
আমি কি আমার স্ত্রীর শরীরের আগে তার মনটাকে বোঝার চেষ্টা করেছি?
আমি কি তার কানের ক্ষুধা মিটিয়েছি? তার প্রশংসায়, তার মনোযোগে?
আমি কি শুধু একজন ‘স্বামী’ হয়েছি, নাকি একজন ‘প্রেমিক’ও হতে পেরেছি?
আমি কি তাকে কথা বলার মতো নিরাপদ আশ্রয়টা দিয়েছিলাম?
যদি এই প্রশ্নগুলোর উত্তর ‘না’ হয়, তবে জেনে রাখুন, আপনার স্ত্রীর বিশ্বাসঘাতকতার গল্পের আপনি শুধু দর্শক নন, আপনিও একজন সহ-লেখক। আপনি হয়তো সরাসরি কলম ধরেননি, কিন্তু আপনিই তাকে সেই গল্পটা লেখার জন্য খালি কাগজটা এগিয়ে দিয়েছিলেন।
এখন বলুন, আপনার রাগ কি কমেছে? নাকি নিজের প্রতিই একরাশ ঘৃণা আর অসহায়ত্ব জন্ম নিচ্ছে? সমাজকে दोष (দোষ) দেওয়ার আগে, নিজের ঘরের বন্ধ দরজাটার দিকে একবার তাকান। হয়তো আসল অপরাধী সেখানেই লুকিয়ে আছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *